Friday, April 13, 2012

বিদ্রোহী:কাজী নজরুল ইসলাম


বিদ্রোহী
       কাজী নজরুল ইসলাম




বিদ্রোহী (কবিতা)
বিদ্রোহী বাংলা ভাষার বিখ্যাত কবিতাসমূহের একটি। এটি কাজী নজরুল ইসলামকাজী নজরুল ইসলাম বিরচিত। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে বিজলী বিজলী পত্রিকায়। প্রকাশিত হওয়ামাত্রই জাগরণ সৃষ্টি করে। দৃপ্ত বিদ্রোহী মানসিকতা এবং অসাধারণ শব্দবিন্যাস ও ছন্দের জন্য আজও বাঙালি মানসে কবিতাটি "চির উন্নত শির" বিরাজমান


                   বল      বীর —
                          বল        উন্নত মম শির,
     শির   নেহারি আমারি    নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রির
                                    বল          বীর

বল           মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি
                 চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি
                  ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া
                   খোদার আসন আরশ ছেদিয়া,
              উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর
মম      ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!

বল         বীর-
   আমি চির উন্নত শির।

                  আমি চিরদুর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস,
 মহা-     প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস,
আমি      মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর,
আমি      দুর্বার,
আমি      ভেঙে করি সব চুরমার!
আমি      অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি      দ'লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!
আমি      মানিনাকো কোনো আইন,
আমি      ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন!
আমি      ধূর্জটি, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর!
আমি      বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সুত বিশ্ব-বিধাত্রীর!
   
   বল        বীর-
        বল          বীর-
 চির-       উন্নত মম শির!

আমি      ঝঞ্ঝা, আমি ঘূর্ণী, আমি পথ-সম্মুখে যাহা পাই যাই চূর্ণী!
আমি      নৃত্য-পাগল ছন্দ, আমি আপনার তালে নেচে যাই,
আমি      মুক্ত জীবনানন্দ। আমি হাম্বীর, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল,
আমি      চল-চঞ্চল, ঠুমকি' ছমকি'
                                    
পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি'
ফিং দিয়া দিই তিন দোল্!

আমি     চপলা-চপল হিন্দোল!
আমি     তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা', করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা,
আমি     উদ্দাম, আমি ঝঞ্ঝা!

আমি     মহামারী, আমি ভীতি এ ধরিত্রীর।
আমি     শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ণ চির-অধীর।
       বল     বীর -
   আমি      চির-উন্নত শির!

           আমি চির-দুরন্ত-দুর্ম্মদ,

আমি     দুর্দ্দম, মম প্রাণের পেয়ালা হর্দ্দম্ হ্যায়্ হর্দ্দম্
            ভরপুর মদ।

আমি     হোম-শিখা, আমি সাগ্নিক, জমদগ্নি, আমি যজ্ঞ,
আমি     পুরোহিত, আমি অগ্নি! আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস,
আমি     লোকালয়, আমি শ্মশান, আমি অবসান, নিশাবসান।
আমি     ইন্দ্রাণি-সূত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য্য, মম এক হাতে-বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ-তূর্য্য।
আমি     কৃষ্ণ-কন্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা বারিধির।
আমি     ব্যোমকেশ, ধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর।
            বল      বীর -
    চির   উন্নত মম শির।

আমি     সন্ন্যাসী, সুর-সৈনিক আমি যুবরাজ,
                       মম রাজবেশ ম্লান গৈরিক!
আমি     বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস,
আমি     আপনা ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ!
আমি     বজ্র, আমি ঈশান-বিষাণে ওঙ্কার,
আমি     ইস্ত্রাফিলের শিঙ্গার মহা-হুঙ্কার,
আমি     পিনাক-পাণির ডমরু-ত্রিশূল, ধর্ম্মরাজের দন্ড,
আমি     চক্র ও মহাশঙ্খ,
আমি     প্রণব-নাদ-প্রচন্ড!
আমি     ক্ষ্যাপা দুর্বাসা-বিশ্বামিত্র-শিষ্য,
আমি     দাবানল-দাহ, দাহন করিব বিশ্ব!
আমি     প্রাণ-খোলা-হাসি উল্লাস, -
আমি     সৃষ্টি-বৈরী মহাত্রাস,
আমি     মহা-প্রলয়ের দ্বাদশ রবির রাহু-গ্রাস!
আমি     কভু প্রশান্ত, - কভু অশান্ত দারুণ স্বেচ্ছাচারী,
আমি     অরুণ খুনের তরুণ,
আমি     বিধির দর্প-হারী!
আমি     প্রভঞ্জনের উচ্ছাস,
আমি     বারিধির মহাকল্লোল,
আমি     উজ্জ্বল আমি প্রোজ্জ্বল,
আমি     উচ্ছল জল-ছল-ছল, চল-ঊর্মির হিন্দোল্ দোল!
আমি     বন্ধন-হারা কুমারীর বেণী, তন্বী-নয়নে বহ্নি,
আমি     ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম-উদ্দাম,
আমি     ধন্যি। আমি উন্মন মন উদাসীর,
আমি     বিধাতার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা-হুতাশ
       
            আমি     হুতাশীর!

আমি     বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির-গৃহহারা যত পথিকের,
আমি     অবমানিতের মরম-বেদনা, বিষ-জ্বালা, প্রিয়-লাঞ্ছিত
      বুকে গতি ফের!
 
আমি     অভিমানী চির-ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়, চিত- চুম্বন-চোর-কম্পন
আমি     থর-থর-থর প্রথম পরশ কুমারীর!
আমি     গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল ক'রে দেখা অনুখন,
আমি     চপল মেয়ের ভালোবাসা, তা'র কাঁকন-চুড়ির কন্-কন্।
আমি     চির-শিশু, চির-কিশোর,
আমি     যৌবন-ভীতু পল্লীবালার আঁচর কাঁচলি নিচোর!
আমি     উত্তর-বায়ু, মলয়-অনিল, উদাসী পূরবী হাওয়া,
আমি     পথিক-কবির গভীর রাগিণী, বেণু-বীনে গান গাওয়া!
আমি     আকুল নিদাঘ-তিয়াসা, আমি রৌদ্র রবি, আমি মরু-নির্ঝর ঝর-ঝর,
আমি     শ্যামলিমা ছায়া-ছবি! -
আমি     তুরিয়ানন্দে ছুটে চলি এ কি উন্মাদ,

আমি     উন্মাদ! আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে
                                       সব বাঁধ!

আমি     উত্থান, আমি পতন,
আমি     অচেতন-চিতে চেতন,
আমি     বিশ্ব-তোরণে বৈজয়ন্তী, মানব বিজয় কেতন! ছুটি ঝড়ের মতন করতালি দিয়া
      স্বর্গ-মর্ত্ত্য করতলে,
            তাজি বোরবাক্ আর উচ্চৈস্রবা বাহন আমার
                             হিম্মত-হ্রেস্বা হেঁকে চলে!

আমি    বসুধা-বক্ষে আগ্নেয়াদ্রি, বাড়ব-বহ্নি, কালানল,
আমি    পাতালে মাতাল অগ্নি-পাথর-কলরোল-কল-কোলাহল!
আমি    তড়িতে চড়িয়া উড়ে চলি জোর তুড়ি দিয়া, দিয়া লম্ফ,
আণি    ত্রাস সঞ্চারি ভুবনে সহসা, সঞ্চরি' ভূমি-কম্প!
       ধরি বাসুকির ফনা জাপটি', -
                     ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি'!
                         আমি দেব-শিশু, আমি চঞ্চল,

আমি     ধৃষ্ট  আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্ব-মায়ের অঞ্চল!
                  আমি  অর্ফিয়াসের বাঁশরী,
                  মহা-  সিন্ধু উতলা ঘুম্-ঘুম্
             ঘুম্ চুমু দিয়ে করি নিখিল বিশ্বে নিঝ্ঝুম্
                         মম বাঁশরী তানে পাশরি'
                       আমি শ্যামের হাতের বাঁশরী।
 
আমি     রুষে উঠে' যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া, ভয়ে সপ্ত নরক হারিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া!
আমি     বিদ্রোহ-বাহী নিখিল অখিল ব্যাপিয়া!
আমি     প্লাবন-বন্যা, কভু ধরণীরে করি বরণিয়া, কভু বিপুল ধ্বংস-ধন্যা -
আমি     ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু-বক্ষ হইতে যুগল কন্যা! আমি অন্যায়, আমি উল্কা,

আমি     শনি,
আমি     ধূমকেতু-জ্বালা, বিষধর কাল-ফণি!
আমি     ছিন্নমস্তা চন্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী,
আমি     জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি!
আমি     মৃণ্ময়, আমি চিন্ময়, আমি অজর অমর অক্ষয়,
আমি     অব্যয়! আমি মানব দানব দেবতার ভয়,
           বিশ্বের আমি চির দুর্জ্জয়,
               জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য,

আমি     তাথিয়া তাথিয়া মথিয়া ফিরি এ স্বর্গ-পাতাল-মর্ত্ত্য
আমি     উন্মাদ, আমি উন্মাদ!!
আমি     চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে
             সব বাঁধ!!

আমি     পরশুরামের কঠোর কুঠার
            নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার!

আমি     হল বলরাম-স্কন্ধে,
আমি     ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে।
             মহা বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি     সেই দিন হব শান্ত,
            যবে উত্‍পীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
                          অত্যাচারীর খড়্‌গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না
                                                                      বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত

আমি     সেই দিন হব শান্ত।

আমি     বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন!
আমি     স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ-হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!
আমি     বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান-বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন!
                                 খেয়ালী-বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!


আমি চির-বিদ্রোহী বীর—
আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির ।

No comments:

Post a Comment

Blogger Widgets